Monday, April 22, 2013

বিদায় বঙ্গাব্দ ১৪১৯


সময় প্রবাহমান। নদীর স্রোতের মতো সময়ও কখনো থেমে থাকে না। বয়ে চলে আপন গতিতে। সময়ের এই প্রবাহমানতায় আজ থেকে মহাকালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে আরেকটি বাংলা বছর।
বঙ্গাব্দ ১৪১৯। আজ শনিবার, ৩০ চৈত্র, ১৪১৯ বঙ্গাব্দের শেষ দিন। আজ চৈত্র সংক্রান্তি। ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক, মুছে যাক গ্লানি….’ বিদায়ী সূর্যের কাছে এ প্রণতি আজ জানাবে বাঙালি। আগামীকাল পূর্বদিগন্ত থেকে ছুটে আসা ভোরের নরম আলো রাঙিয়ে দেবে পৃথিবী, স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনায় সূচিত হবে নতুন বছর। বাংলা বছরের সমাপনী মাস চৈত্রের শেষ দিনটিকে ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ বলা হয়। লৌকিক
আচার অনুযায়ী এ দিনে বিদায় উৎসব পালন করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। দোকানপাট ধুয়ে-মুছে বিগত বছরের যত সব জঞ্জাল, অশুচিতাকে বিদূরিত করা হয়। পরদিনই খোলা হবে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের নতুন খাতা। সে উৎসবের লোকায়ত নাম ‘হালখাতা’। ওই উৎসবে নিকোনো পরিচ্ছন্ন বিপণী অঙ্গন, ধূপ ধূনোর সুগন্ধি ভারি করে রাখে ঘরের পরিবেশ। তদুপরি অভ্যাগত এলেই গোলাপ পানির ছড়ি ছিটানোয় তার অভ্যর্থনা। সারা বছরের খরিদ্দারদের
কাছে বকেয়া টাকা তুলতে বছরের
এই দিনটিকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার রেওয়াজ কত শত বছরের তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়।
এ ছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন
প্রান্তে বসেছে মেলা। বাংলা পিডিয়া সূত্রে জানা গেছে,
অতীতে চৈত্র সংক্রান্তি মেলা উপলক্ষে গ্রামাঞ্চলের
গৃহস্থরা নাতি-নাতনিসহ মেয়ে জামাইকে সমাদর করে বাড়ি নিয়ে আসত। গৃহস্থরা সবাইকে নতুন জামা- কাপড় দিত এবং উন্নত মানের খাওয়া-দাওয়ারও আয়োজন করত।
মেলার কয়েকদিন এভাবে সবাই আনন্দ উপভোগ করত। বর্তমানে শহুরে সভ্যতার ছোঁয়া লাগায় আবহমান গ্রামবাংলার সেই আনন্দমুখর পরিবেশ আর আগের মতো নেই। তবে এখন শহরাঞ্চলের নগর সংস্কৃতির আমেজে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবে মেলা বসে, যা এক সর্বজনীন মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
সনাতন মতে, বাংলা মাসের শেষ দিনে শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস
প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যের
কাজ বলে মনে করা হয়। গ্রীষ্মের প্রচ- দাবদাহে উদ্বিগ্ন কৃষককুল নিজেদের বাঁচার তাগিদে বর্ষার আগমন দ্রুত হোক, এই প্রণতি জানাতেই চৈত্র মাসজুড়ে উৎসবের মধ্যে সূর্যের কৃপা প্রার্থনা করে। এখন সূর্য তার রুদ্ররূপে প্রতিভাত। তাই চৈত্র
সংক্রান্তিতে নানা উপাচারের নৈবেদ্য দিয়ে তাকে তুষ্ট করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
নানা আয়োজনে আজ যখন চৈত্র সংক্রান্তির পার্বণ, তখন একই সঙ্গে দুয়ারে কড়া নাড়ছে বাঙালির
সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখ। আজ শনিবার রাত পোহালেই কাল নতুন দিন। শুধু নতুন দিনই নয়, একই সঙ্গে নতুন বছরও। নতুন বছর ১৪২০-কে স্বাগত জানাতে পুরো বাংলাদেশ এখন উন্মুখ। পুরো দেশ যেন এখন পরিণত হয়েছে এক উৎসবমুখর দেশে। বৈশাখকে বরণ করার জন্য সবখানেই এখন চলছে সাজগোজ আর ধোয়া-মোছা। নববর্ষের নানা আয়োজনে ব্যস্ত এখন উৎসবপ্রেমীরা। আর সব প্রস্তুতিই এখন শেষ পর্যায়ে।
চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন
প্রান্তে বসেছে বৈশাখীমেলা। আর এসব মেলায় থাকবে নানা ধরনের পিঠাপুলি আর হাওয়াই মিঠাই। পুরনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা মিলল লাল মলাটের হালখাতা নিয়ে নতুন বছরের অপেক্ষায় ব্যবসায়ীরা। পুরনো বছরের হিসাব-নিকাশ
ঘুচিয়ে ফেলে ক্রেতার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরি করবে মিষ্টিমুখ করে। তাঁতি বাজারের স্বর্ণকার নির্মাতা বর্ধন কর্মকারহ্যালো-
টুডে ডটকমকে বলেন, পুরো দোকানপাট রঙ করে ধুয়ে- মুছে আমরা অপেক্ষা করছি পহেলা বৈশাখের
জন্য। ইতোমধ্যে অনেকেই হালখাতার কাজ শেষ করে ফেলেছে বলেও জানান বর্ধন।বছরের শেষ দিনটিতে আজ চৈত্র সংক্রান্তির মেলা ও নানা পর্ব মনে করিয়ে দিচ্ছে নতুন বছর দোরগোড়ায়। সাদর আমন্ত্রণে মাঙ্গলিক চিন্তা ও
শুভবোধের
উদ্বোধনে হৃদয়সিক্ত প্রাপ্তির ডালিতে নতুনের অভিষেকের দিন পহেলা বৈশাখ কাল। শুভ হালখাতা, মেলা, গান- বাজনা, প্রদর্শনী ইত্যকার নানা আয়োজনে বাঙালি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সম্ভারে উদযাপন করবে এ দিনটি। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে লোকমেলার
আয়োজন গ্রাম-গঞ্জেই হয় বেশি। মেলা, গান, বাজনা ও যাত্রাপালাসহ
নানা আয়োজনে উঠে আসে লোকজসংস্কৃতির
নানা সম্ভার। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মেতে ওঠে পুজো অর্চনায়।
তবে সূর্যের কৃপা প্রার্থনায় কৃষককুল চৈত্রজুড়েই পালন করে প্রার্থনা উৎসবের। বিশেষ করে হিন্দুরা আয়োজন করেছে চড়ক পুজোর।
এদিকে, চৈত্র সংক্রান্তির উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আয়োজন রবীন্দ্র
সঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার
প্রতিষ্ঠান ‘সুরের ধারা’ ও চ্যানেল আই। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উন্মুক্ত প্রান্তরে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাতাবদ্যি চলবে চৈত্র
সংক্রান্তির আয়োজন। এছাড়াও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি
গত বছরের যত হতাশা_ক্লান্তি, অপ্রাপ্তি-বেদনা ও হাহাকারের পালা সাঙ্গ করে নতুন বছর নতুন উদ্দীপনা এবং নতুন আমেজ নিয়ে হবে উপস্থিত। যেন নব আনন্দে স্বপ্নের ডাক দিচ্ছে পরবর্তী বছর। বহুমুখী লোকাচার ও দেশজ সংস্কৃতির বর্ণিল উৎসব আয়োজনে বাঙালি এখন প্রস্তুত
নববর্ষ আহ্বানের জন্য। এদিকে বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক,
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
প্রস্তুতি এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। ছায়ানট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদসহ সংশ্লিষ্টরা বর্ষবরণের জন্য এবার গ্রহণ করেছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
বাংলা নববর্ষকে বরণের জন্য রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান
আয়োজন ছায়ানটের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। রমনা বটমূলে গতকাল শেষ হয়েছে মঞ্চ নির্মাণ। শুরু হয়েছে মঞ্চ সাজানো। গত মাস থেকে শুরু হয়েছিল ছায়ানটের
সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া। গতকাল ছায়ানট ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে চূড়ান্ত মহড়া। অনুষ্ঠানের সব গ্রুপ গতকাল একসঙ্গে মহড়ায় অংশ নেন। ছায়ানট কর্তৃপক্ষ জানায়, মোট ১৩৭ জন শিল্পী এবারের বর্ষবরণের উৎসবে অংশ নিচ্ছে।
পহেলা বৈশাখের অন্যতম বড় আকর্ষণ হচ্ছে_ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা শিক্ষার্থীদের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ‘রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ/ মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ’ সস্নোগান নিয়ে রোববার সকাল ৯টায়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর নেতৃত্ব দেবেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কারণে এবারের
শোভাযাত্রার রুট খানিকটা পরিবর্তন করা হয়েছে। শোভাযাত্রাটি চারুকলার সামনে থেকে শুরু হবে। টিএসসি, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হবে শোভাযাত্রাটি।
মঙ্গল
শোভাযাত্রাটি সফলভাবে আয়োজন
করার জন্য ১৭ মার্চ দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আজ সন্ধ্যার মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আনা হবে।
বরাবরের মতো লোকজ ধারার শিল্পকর্ম
থাকবে শোভাযাত্রাজুড়ে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ
বিচার প্রসঙ্গটি। আর এই বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে বিরাট
এক সরীসৃপের মাথায় থাকছে যুদ্ধাপরাধীর ভয়ঙ্কর মুখ। প্রায় ৬৫ ফুট দীর্ঘ সরীসৃপাকৃতি এই শিল্পকর্মটি অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হবে। ‘বিদ্রোহী ষাড়’ শিরোনামে শিল্পকর্মে তুলে ধরা হবে জনতার
প্রতীক হিসেবে। দেশের চলমান অস্থিরতা এবং অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জনতার সোচ্চার প্রতিবাদ হিসেবে এই শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়েছে। ১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ‘শান্তির পায়রা’ শিল্পকর্মে তুলে ধরা হবে দেশের
মানুষ শান্তি চায়, কোনো হানাহানি নয়। শোভাযাত্রায় থাকছে যশোর- ঝিনাইদহের লোকজ ফর্মের শিল্পকর্ম ‘শোলার জোড়াপাখি’। এই শিল্পকর্মটি অসাম্প্রদায়িক
ও রাজনৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পরিহার করে শান্তির পথে আসার আহ্বান করা হবে। থাকবে মুষ্টিবদ্ধ হাত, বিদ্রোহের শিল্পকর্ম। মূলত এটি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের
প্রতীক।
শোভাযাত্রা থাকবে ১২টি টাট্টু
ঘোড়া। আরো থাকছে বড়- ছোটো প্রায় ১০০টি মুখোশ। মুখোশে তুলে ধরা হবে রাজা- রানী, উজির-নাজির, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, খরগোশ, বাংলার বাঘ, ধূর্ত শেয়ালের প্রতীক। শোভাযাত্রায় যাতে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির
ঘটনা না ঘটে সেজন্য থাকবে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এ ছাড়া বরাবরের মতো এবারো চারুকলা অনুষদের সামনে দেয়ালে অাঁকা হবে চিত্রকর্ম।
দু’জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে চিত্রকর্ম অাঁকছেন ৫ জন শিক্ষার্থী। দু’জন শিক্ষক হলেন_ প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষক গুপু ত্রিবেদী ও পেইন্টিং বিভাগের শিক্ষক আবদুস সাত্তার তৌফিক। শিক্ষার্থীরা হলেন_ রত্ন, অমিত, জ্যোতি, মারমা ও সুফিয়ান। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে চিত্রকর্ম অাঁকা।
এসব আয়োজনের পাশাপাশি রমনা বটমূলে পান্তা-
ইলিশের স্টল দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
ছাত্রছাত্রীদের
মধ্যে এখনো চলছে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। এ ছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত
হতে যাচ্ছে নানা অনুষ্ঠান।

No comments:

Post a Comment